বিবিসি বাজার – BBC Bazaar রূপপুর, ঈশ্বরদী।
- আপডেট সময় : ১০:২৬:৫৬ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২২ অক্টোবর ২০২৩ ২২৯ বার পড়া হয়েছে
এবিসি নিউজ ডেস্কঃ
১৯৭১ সাল। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ক্যাম্প বসিয়েছে পাকশী পেপার মিল ও হার্ডিঞ্জ ব্রিজ এলাকাতে। সেখান থেকে খুব কাছেই রুপপুর গ্রাম। সে গ্রামে রাস্তার পাশের এক কড়ইতলায় ছোট্ট একটি চায়ের দোকান বসায় এক দোকানী। সবার কাছে সেটি মোল্লার দোকান। গ্রামের মানুষ কাশেম মোল্লাকেই ভালবেসে ডাকতো ‘মোল্লা’ বলে।
রুপপুরসহ আশপাশের গ্রামের সবাই ছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের। অনেক পরিবারেরই যুবক ছেলেরা গিয়েছে মুক্তিযুদ্ধে। পাকিস্তানীরা নির্বিচারে জ্বালিয়ে দিচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম। সবাই উৎকন্ঠা আর আতংকে দিন কাটাচ্ছে। দেশের কোন খবর জানে না কেউ। রেডিও পাকিস্তান এ সঠিক কোন খবর নেই। যা খবর পাওয়া যায় তা শুধুই বিবিসি, ভয়েজ অব আমেরিকা, কলকাতা বেতার আর স্বাধীন বাংলা বেতারে।
দশ গ্রামের মধ্যে শুধু কাশেম মোল্লারই ছিল একটি থ্রি ব্যান্ডের ফিলিপস রেডিও। প্রতি সন্ধ্যায় চায়ের দোকানে বসে তিনি শর্টওয়েভে সবাইকে বিবিসির খবর শোনাতেন। বিবিসিতে দেশের খবর, মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের খবর শুনতে চায়ের দোকানে ভীড় লেগে যেত। ক্রমেই ভীড় আরো বাড়তে থাকলো। চায়ের দোকানের পাশে গড়ে ওঠলো আরো বেশ কয়েকটি দোকান। এভাবে তৈরী হয় একটি গ্রাম্য বাজারের।
সন্ধ্যে হলেই রুপপুর গ্রামে হাকডাক শুরু হতো। গ্রামের লোকেরা একে অন্যকে বলতো, ‘চল বিবিসি শুনতে যাই’। এভাবে মোল্লার দোকানে বিবিসির খবর শোনাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা বাজারের নাম প্রথমে ‘বিবিসি শোনার বাজার’ এবং পরে তা হয়ে যায় ‘বিবিসি বাজার’।
পাকিস্তান আর্মিদের গাড়ির শব্দ পেলেই সবাই চায়ের দোকান থেকে সরে পড়তো গ্রামের ঝোপঝারে। তারা জানালো জীবনকে বাজী রেখেই কাশেম মোল্লা সবাইকে বিবিসির খবর শোনাতো । সে সময় মোল্লার দোকানে বিবিসির খবর শুনে উদ্বুদ্ধ হয়ে যুদ্ধে গিয়েছে শত শত যুবক। এভাবে বিবিসি বাজার, সেই কড়ইগাছ আর কাশেম মোল্লা জায়গা করে নেয় ইতিহাসের পাতায়।
বিবিসি নামে একটি বাজারের নামকরণের কথা শুনে বিবিসির ৫০ বছরপূর্তি উপলক্ষে ১৯৯২ সালে এখানে এসেছিলেন বিবিসির তৎকালীন ‘ইষ্টার্ন সার্ভিস সেকশন’ এর প্রধান ব্যারি ল্যাংরিজ, বাংলা সার্ভিস এর উপপ্রধান সিরাজুল ইসলাম, প্রযোজক ও প্রেজেন্টার দীপন্কর ঘোষ এবং সংবাদদাতা আতাউস সামাদ। বিবিসি শোনার সেই রেডিওটি কোথায়? এমন প্রশ্নে সামাদ নিশ্চুপ থাকে। পরে জানালো স্বাধীনের পর অভাবের কারণে তার বাবা কাশেম বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয় ৭১ এর স্মৃতি বিজড়িত সেই রেডিওটি।
বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন কাশেম মোল্লা। হানাদার বাহিনীর আঘাতে জখম হওয়া পা নিয়ে চলছেন খুড়িয়ে খুড়িয়ে লাঠিতে ভর দিয়ে। চা খেতে খেতে কাশেম মোল্লা বলেন মুক্তিযুদ্ধের সে সময়কার কথাগুলো।
অভাবের কারণে ক্লাস সেভেনের বেশী পড়া হয়নি কাশেমের। ফলে জীবন টিকাতে নেমে পড়েন টুকিটাকি ব্যবসায়। এক সময় পাকশী রেল বাজারে দেন একটি মুদি দোকান। ৭১ এর ২৫ মার্চের পরে পাকিস্তানী আর্মি বাজার পুড়িয়ে দিলে তিনি চলে যান নিজ গ্রাম রুপপুরে। নিজের হাতে লাগানো কড়ইতলীতে বসান ছোট্ট একটি চায়ের দোকান।
বিয়ের পরে স্ত্রী আনোয়ারা বেগম আবদার করে একটি রেডিও কিনার। রেডিও শোনার প্রতি কাশেমেরও এক ধরনের ঝোক ছিল। তাই টাকা জমিয়ে তিনি কিনলেন একটি থ্রী ব্যান্ডের ফিলিপস রেডিও। কাশেম মোল্লার সেই রেডিওই হয়ে যায় ইতিহাস।
গা, তুম রেডিও নিকালো’। কাশেম বলেন সেনাদের কথায় আমার জানে তো পানি নাই। ভেবেছিলাম মাইরে ফেলবি। আমি কলেম ‘ও চিজ হামারা নেহি হে, আদমি লোক খবর লেকে আতা হে শুনালকে লেকে চলে যাতা হে’। কথা শুনে আর্মিরা রোলার দিয়ে কাশেমের ডান পায়ে বেশ কয়েকটা বাড়ি দেয়। যার কারণেই এখন আর তিনি ডান পায়ে ভর দিয়ে চলতে পারেন না। খুড়িয়ে খুড়িয়েই বৃদ্ধবয়সেও মসজিদে আসতেন, প্রায় প্রতিদিনই দেখা যেতো মসজিদে।
সেই রেডিওটি অনেক আগেই থেমে গিয়েছিল। গত ৬ই ফেব্রুয়ারী ২০১৫ শুক্রবার ভোর চারটায় ৭৫ বছর বয়সে থেমে গেলেন তিনি নিজেই। তবে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এ মানুষটি পেলেন না মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি।
_(সংগৃহীত)