কিশোরীদের সুরক্ষায় কাজ করছেন শারমিন ও মরিয়ম

- আপডেট সময় : ০৩:৩১:৩৯ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৬ মার্চ ২০২৫ ৫ বার পড়া হয়েছে

আনোয়ার সাঈদ তিতু,
কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি:-
বাল্যবিয়ে নিরোধ আইন, বাল্যবিয়ের কুফল ও প্রতিরোধে করণীয় এবং যৌনস্বাস্থ্য শিক্ষাসহ নানা বিষয়ে প্রত্যন্ত গ্রামের কিশোরীদের নিয়ে নিয়মিত ক্যাম্পেইন করেন শারমিন আক্তার ও মরিয়ম। তাদের ক্যাম্পেইনে অংশ নেওয়া সবাই স্কুলশিক্ষার্থী এবং বাল্যবিয়ের ঝুঁকিতে থাকা শিশু। বাল্যবিয়ের হাত থেকে কিশোরীদের রক্ষা ও স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি নিয়ে শারমিন এবং মরিয়মের এই সুরক্ষা যুদ্ধ প্রত্যন্ত গ্রামের স্কুলশিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মাঝে দারুণ সাড়া ফেলেছে।
শারমিনের বাড়ি কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার থেতরাই ইউনিয়নের গোড়াইপিয়ার গ্রামে আর মরিয়মের বাড়ি একই ইউনিয়নের হোকোভাঙা গ্রামে। গত বৃহস্পতিবার (১৩ মার্চ) দুপুরে ইউনিয়নের থেতরাই ফেডারেশন প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত বাল্যবিয়ে নিরোধ আইন, জন্মনিবন্ধন এবং বিয়ে রেজিস্ট্রেশন বিষয়ক একটি ক্যাম্পেইনে কথা হয় এই দুই কিশোরীর সঙ্গে। বাল্যবিয়ের ঝুঁকিতে থাকা ৪০ জন স্কুলশিক্ষার্থী এই ক্যাম্পেইনে অংশ নেয়। উপজেলার হাতিয়া ইউনিয়নের ফেডারেশন প্রাঙ্গণে একই বিষয়ে আরেকটি ক্যাম্পেইনে অংশ নেয় ওই ইউনিয়নের আরও ৪০ স্কুলশিক্ষার্থী। আরডিআরএস বাংলাদেশের চাইল্ড নট ব্রাইড (সিএনবি) প্রকল্পের যুব সংগঠন এ ক্যাম্পেইনের আয়োজন করে। এতে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের মাঝে প্রকল্পের পক্ষ থেকে শিক্ষা উপকরণ বিতরণ করা হয়।
শারমিন জানান, তিনি বর্তমানে স্নাতক প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। ছয় মাস ধরে বাল্যবিয়ের ঝুঁকিতে থাকা গ্রামের কিশোরীদের নিয়ে নিয়মিত ক্যাম্পেইন করছেন। সিএনবি প্রকল্পের এসব ক্যাম্পেইনে বাল্যবিয়ের কুফল, বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ, বাল্যবিয়ে নিরোধ আইন, কিশোরীদের যৌনস্বাস্থ্য শিক্ষা, জেন্ডার সমতা, যৌন হয়রানি ও ইভটিজিং প্রতিরোধসহ নানা বিষয়ে সুরক্ষামূলক আলোচনা করা হয়। এতে প্রত্যন্ত গ্রামের কিশোরীরা যেমন সচেতন হয়ে উঠছে তেমনি তারা নিজেদের মধ্যে সাহস ও নৈতিক শক্তি সঞ্চার করতে সক্ষম হচ্ছে।
শারমিন বলেন, ‘দরিদ্র বাবার ঘরে আমার বেড়ে ওঠা। নিজেও বাল্যবিয়ের ঝুঁকিতে ছিলাম। সিএনবি প্রকল্পের মাধ্যমে বাল্যবিয়ের কুফল নিয়ে জেনেছি। পরিবারকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছি। এখন আমি এই প্রকল্পে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে অন্য ঝুঁকিপূর্ণ কিশোরীদের বাল্যবিয়ে থেকে রক্ষা ও সুরক্ষা সচেতনতা নিয়ে কাজ করছি। নিজে উপকৃত হয়ে অন্যদের জন্য কাজ করছি। গ্রামের কিশোরীদের মাঝে লক্ষণীয় পরিবর্তন এসেছে। অভিভাবকরাও সহযোগিতা করছেন। বাল্যবিয়ে এখন আর সহজসাধ্য নয়।’
মরিয়ম দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ে। দরিদ্র পরিবারের এই কিশোরী নিজেকে বাল্যবিয়ে থেকে রক্ষার পাশাপাশি গ্রামের অন্য কিশোরীদের সুরক্ষা নিয়ে কাজ করছেন। স্কুলপড়ুয়া কিশোরীদের সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সম্ভাব্য ঝুঁকি থেকে মুক্ত রাখতে সহায়তা করছেন।
এ বিষয়ে মরিয়ম বলেন, ‘গ্রামের দরিদ্র পরিবারের মেয়েদের বাল্যবিয়ের ঝুঁকি বেশি। এ ছাড়া যৌনস্বাস্থ্য শিক্ষা ও জেন্ডার সমতা নিয়ে কিশোরী এবং অভিভাবকদের মধ্যে বেশ জড়তা কাজ করে। আমি মেয়েদের সচেতন করার চেষ্টা করছি। বেশ সাড়া পাচ্ছি।’
ক্যাম্পেইনে অংশ নেওয়া স্কুলশিক্ষার্থী সানজিদা জানায়, সিএনবি প্রকল্পের সেশনে নিয়মিত অংশ নিচ্ছি। বাল্যবিয়ের কুফলসহ বিভিন্ন বিষয়ে জানতে পারছি। স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিষয়ে শিখছি। আমার মতো অনেক স্কুলশিক্ষার্থী এসব বিষয়ে সচেতন হচ্ছে।
ক্যাম্পেইনে উপস্থিত স্থানীয় ইউপি সদস্য ও অভিভাবক আব্দুল হালিম বলেন, ‘মেয়েরা অনেক সচেতন হয়ে উঠছে। এভাবে সচেতনতা বাড়লে গোপনেও বাল্যবিয়ে দেওয়া সম্ভব হবে না। এই অভিশাপ থেকে আমাদের মেয়েরা রক্ষা পাবে।’
বৃহস্পতিবার উলিপুরের হাতিয়া ইউনিয়ন ফেডারেশনে একই বিষয়ে ক্যাম্পেইনে অংশ নেওয়া কিশোরীদের সঙ্গে কথা হয়। তারা জানায়, শুধু বাল্যবিয়ে নয়, জন্ম নিবন্ধনের প্রয়োজনীয়তা, জেন্ডার সমতা, জরায়ু মুখের স্বাস্থ্য সুরক্ষাসহ অনেক বিষয় নিয়ে সেশনে তারা নিয়মিত অংশ নিচ্ছে। পরিবার তাদের সহযোগিতা করছে।
এই ক্যাম্পেইনে উপস্থিত স্কুলশিক্ষার্থী কাকলি ও রাজিয়ার ভাষ্য, আমরা স্কুল কিংবা বাড়িতে এসব বিষয় নিয়ে কখনও জানতে পারি না। কিন্তু এসব সেশনে অংশ নিয়ে অনেক কিছু জানতে পারছি। আমরা শপথ নিয়েছি বাল্যবিয়ে করবো না, আমাদের আশপাশে অন্য কারও বাল্যবিয়ে হতে দেবো না।
হাতিয়া বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও সিএনপি প্রকল্পের ইয়োথ চ্যাম্পিয়ন কুমারি শম্পা রানী বলেন, ‘গ্রামের দরিদ্র মেয়েরা বাল্যবিয়ের ঝুঁকিতে থাকে। আমরা তাদের সচেতনতা নিয়ে কাজ করছি। সেশন পরিচালনার মাধ্যমে বাল্যবিয়ে নিরোধ আইন, জন্ম নিবন্ধনের গুরুত্ব ও কিশোরীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষাসহ বিভিন্ন বিষয়ে সচেতন করা হচ্ছে।’
সিএনবি প্রকল্পের কুড়িগ্রাম জেলা সমন্বয়কারী অলিক রাংসা বলেন, ‘এনআরকে-টেলিনথ ও প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ এই প্রকল্পে আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতা করছে। এই প্রকল্পের মূল লক্ষ্য হলো বাংলাদেশ, বিশেষ করে কুড়িগ্রাম জেলায় বাল্যবিয়ে ও জোরপূর্বক বিয়ের হার কমিয়ে আনা। আমাদের লক্ষ্য বাল্যবিয়ের ঝুঁকিতে থাকা শিশুরা যেন স্কুলমুখী হয়ে শিক্ষাগ্রহণে অনুপ্রাণিত হয়। কারণ শিক্ষাই পারে বাল্যবিয়ের অভিশাপ থেকে রক্ষা করতে। পাশাপাশি প্রকল্পের আওতাভুক্ত ঝুঁকিপূর্ণ শিশুদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও জেন্ডার সমতা নিয়েও সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।’