হাফিজ মাছুম আহমদ দুধরচকী:
ইসলাম ধর্ম যে-কয়টি ইলম অর্জনের তাগিদ প্রদান করে এর বাইরে অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্বীনি ইলম চর্চার সময় ও ইচ্ছার অভাব সাধারণত অনেক আলিমগণের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। যেমন কেউ শুধু ইলমুল আকাঈদ নিয়ে ব্যস্ত, কেউ শুধু ইলমুল ফিকহ, আবার কেউ শুধু ইলমুত তাসাউফ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। কিন্তু বিশুদ্ধ তরিকা হল, ইসলাম ধর্ম-সংশ্লিষ্ট ইলম উক্ত তিন ইলমের সমষ্টির নাম। হযরত আল্লামা মুফতি মুজাহিদ উদ্দিন চৌধুরী দুবাগী ছাহেব (রহ.) এমন এক সৌভাগ্যবান মুত্তাকী ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মনিষী ছিলেন সমকালীন সময়ে যার তুলনা বিরল। ইমাম মালেক (রহ.) বলেন- যে ব্যক্তি শুধু ফিকহ-এর ইলম শিখলেন কিন্তু তাসাউফ হাসিল করলেন না, সে ফাসিক। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি শুধু তাসাউফের ইলম হাসিল করলেন কিন্তু ফিকহ শিখলেন না, সে ধর্মদ্রোহী। আবার যিনি উভয় বিষয়ের ইলম লাভ করলেন, তিনি যথার্থ কাজ করলেন। অর্থাৎ প্রকৃতপক্ষে তিনিই হলেন ওরাসাতুল আম্বিয়া।
আল্লামা দুবাগী ছাহেব (রহ.) ইলমে কুরআন, ইলমে হাদীস, ইলমে ফিকহ, ইলমে আকাঈদ, ইলমে তাসাউফ তথা শরীয়ত ও মারিফতের প্রয়োজনীয় সর্বপ্রকার ইলম অর্জন করে ব্যবহারিক জীবনে সফলতার সাথে বাস্তবায়নে নজির স্থাপন করেছেন। আমার পরম শ্রদ্ধেয় উস্তাযুল মুকাররম হযরত আল্লামা মুফতি মুজাহিদ উদ্দিন চৌধুরী দুবাগী হুজুরের অবদান কখনো ভুলার নয়। সৎপুর দারুল হাদীস কামিল মাদরাসায় অধ্যয়নকালে হুজুরের সাথে যে মধুর স্মৃতি রয়েছে তা আজও স্মরণ আছে। খেয়াল করলে হুজুরের নসিহত, কথাবার্তা, পাঠদান ইত্যাদি চোখের সামনে এখনো ভেসে উঠে। এমন বিজ্ঞ ও পাণ্ডিত্যের অধিকারী উস্তাযের ফয়েজ প্রাপ্তি সৌভাগ্যের ব্যাপার।
যেসব মনীষাগণের অবয়ব দেখলে আল্লাহর কথা স্মরণ আসে তারাই হলেন ওলীআল্লাহ। হযরত আল্লামা দুবাগী হুজুর (রহ.) ছিলেন এমন উঁচু মার্গের এক বুযুর্গ। তিনি বেশ জবরদস্ত আলিমে দ্বীন হিসেবে তখনও মশহুর ছিলেন। আপাদমস্তক সুন্নতে নববীর পাবন্দ, মুখাবয়বে আশিকে রাসুলের ছাপ তথা ছিরতে ছুরতেও তিনি-যে একজন আল্লাহর ওলী তা প্রকাশিত ছিল। তিনি আল্লাহর নৈকট্য লাভে ধন্য হয়েছিলেন। আকিদা ও আমলে ছিলেন সত্যের প্রতিবিম্ব। আমল-আখলাক, নম্রতা-ভদ্রতা, ইবাদত-বন্দেগী ইত্যাদিতে ছিলেন অতুলনীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী।
সৎপুর দারুল হাদীস কামিল মাদরাসা তখন ছিল খ্যাতিসম্পন্ন এক দারসে হাদীসের বাগান। মাদরাসার মুহতারাম আসাতিযায়ে কিরাম যেমন ছিলেন যুগের শ্রেষ্ঠ ও যোগ্য উস্তায তেমনি তাদের নেক সোহবতে সৃষ্টি হয়েছিলেন অসংখ্য যোগ্য আলিমে-দ্বীন। বাদেদেওরাইল ফুলতলী কামিল মাদরাসা থেকে ১৯৬৭ সালে দাখিল জামাত উত্তীর্ণের পর সৎপুর দারুল হাদিস কামিল মাদরাসায় ভর্তি হওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়। আলিম, ফাজিল ও কামিল জামাত সৎপুর মাদরাসা থেকে সম্পন্ন করি। আমার সহপাঠীগণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- মাওলানা মো. রইছ উদ্দিন হামজাপুরী (প্রাক্তন শায়খুল হাদীস, সৎপুর দারুল হাদিস কামিল মাদরাসা), মাওলানা মো. ইমাদ উদ্দিন (ওরফে সাজিদুর রহমান), মাওলানা মো. তৈয়্যিবুর রহমান (প্রাক্তন অধ্যক্ষ, বিশ্বনাথ দারুল উলুম ইসলামিয়া কামিল মাদরাসা) মাওলানা মো. মাশুক আহমদ (প্রাক্তন অধ্যক্ষ, ইছামতি দারুল উলুম কামিল মাদরাসা), মাওলানা মো. শফিকুর রহমান (প্রাক্তন সুপার, থানাবাজার দাখিল মাদরাসা, জকিগঞ্জ), মাওলানা মো. আব্দুশ শহীদ ঘোরী (প্রাক্তন সুপার, দিনারপুর আইনগাঁও দাখিল মাদরাসা, নবীগঞ্জ), মাওলানা মো. আব্দুল আলি (প্রাক্তন ইমাম ও খতিব, শাহজালাল জামে মসজিদ, ওয়ালসল, ইউকে), মাওলানা মো. আব্দুল মালিক (প্রাক্তন আরবি প্রভাষক, ফতেহপুর কামিল মাদরাসা, সিলেট), মাওলানা মো. হুছাইন আহমদ, মাওলানা মো. হবিবুর রহমান, মাওলানা মো. নূরুল ইসলাম ও মাওলানা মো. আব্দুল্লাহ (নেত্রকোনা) প্রমূখ।
সৎপুর দারুল হাদীস কামিল মাদরাসায় পাওয়া পরম শ্রদ্ধাভাজন উস্তাযমণ্ডলীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- হযরত আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (রহ.), হযরত মাওলানা মুফতি মুজাহিদ উদ্দিন চৌধুরী দুবাগী হুজুর, হযরত মাওলানা মো. হবিবুর রহমান রারাই'র মুহাদ্দিস ছাহেব, হযরত মাওলানা আব্দুল জব্বার গুটারগ্রামী মুহাদ্দিস ছাহেব, হযরত মাওলানা মো. মোতাহির আলী বাল্লাহ'র মুহাদ্দিস ছাহেব, হযরত মাওলানা মো. ফজলুল করীম টাংগাইলের হুযূর, হযরত মাওলানা খলিলুর রহমান রারাই'র হুজুর, হযরত মাওলানা মুফতি মো. হারিছ উদ্দিন আটগ্রামী হুজুর, হযরত মাওলানা ইরশাদ হোসেন গুয়াহুরির হুজুর এবং হযরত মাওলানা মো. আব্দুছ ছালাম তেলিকোনা'র হুজুর।
১৯৭৩ সালে প্রথম বিভাগে কামিল পাশের ঘটনায় আল্লামা মুফতি মুজাহিদ উদ্দিন চৌধুরী দুবাগী (রহ.) হুজুরের অবদান বিশেষ প্রণিধানযোগ্য। সে বছর মাদরাসার কামিল জামাতের ফলাফলের ইতিহাসে সর্বপ্রথম তিনটি 'প্রথম বিভাগ' এসেছিল। এর একটি আমার সৌভাগ্যে ঘটেছিল এবং বাকি দু’জন হলেন মাওলানা মো. রইছ উদ্দিন হামযাপুরী (রহ.) ও মাওলানা ইমাদ উদ্দিন ওরফে সাজিদুর রহমান (রহ.) (ছাতক থানার ধারণ নিবাসী)। এছাড়া সিলেট বিভাগের মধ্যে সিলেট সরকারী আলিয়া মাদরাসায় ১টি এবং গাছবাড়ী কামিল মাদরাসায় ১টি প্রথম বিভাগ এসেছিল। তখন কামিলে প্রথম বিভাগে পাশ করা বেশ সম্মানের বিষয় ছিল। তাই প্রথম বিভাগ পাওয়ার সংবাদ মশহুর হয়ে গেলো। প্রথম বিভাগ কিভাবে লাভ করা যায় এব্যাপারে আমার কাছে কেউ জিজ্ঞেস করলে বলতাম, লেখাপড়ায় অধ্যবসায়ী হওয়ার পাশাপাশি হস্তলিপি সুন্দর করতে হবে। তখনই উদাহরণ টেনে আল্লামা মুফতি মুজাহিদ উদ্দিন চৌধুরী দুবাগী (রহ.) হুজুরের নাম বলতাম।
উল্লেখ্য যে, আমি যখন প্রাথমিক শিক্ষা শেষে কওমি মাদরাসায় কয়েকবছর লেখাপড়া করি তখন আরবী, উর্দু ও ফারসি হস্তাক্ষর বেশ চমৎকার হয়ে উঠে। অতঃপর যখন সৎপুর মাদরাসায় আসি তখন দেখতে পাই অসংখ্য তালাবা দুবাগী হুজুরের খেদমতে ভীড় করেন। কারণ, দুবাগী হুজুরের আরবী, উর্দু ও ফারসি ভাষায় যেমন পারদর্শীতা ছিল ঠিক অনুরূপ উক্ত ভাষার হস্তাক্ষরও ছিল অত্যন্ত সুন্দর। তাই ছাত্রবৃন্দ সবসময় হুজুরের খেদমতে খাতা কলম নিয়ে হাজির হতেন। হুজুর সবার খাতার শীর্ষে একটি করে লাইন লিখে দিতেন আর ছাত্রবৃন্দ তাঁর লেখার অনুসরণে পুরো এক পৃষ্ঠা লিখতেন। আমিও হুজুরের খেদমতে হাজির হই। হুজুর আমাকে দেখে স্বভাবসুলভ মুচকি হেসে বলেন, আপনার হস্তাক্ষর বেশ সুন্দর। চেষ্টা করলে ইনশাআল্লাহ আরও সুন্দর হবে এবং পরীক্ষার ফলাফলে কাজে লাগবে।
আল্লামা মুফতি মুজাহিদ উদ্দিন চৌধুরী দুবাগী হুজুরের অসংখ্য অবদানের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য এই হস্তাক্ষর সুন্দর করার অবদানটি তখনকার সময়ের অসংখ্য আলিম-ওলামার জীবনে রয়েছে। আমার ও মাওলানা হামজাপুরী এবং মাওলানা ইমাদ উদ্দিনের 'কামিলে প্রথম বিভাগ' পাওয়ার পেছনে দুবাগী হুজুরের হস্তাক্ষর অনুসরণ করে আমাদের হস্তাক্ষর আরও সুন্দর করার বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। এছাড়া উঁচু দরজার এ আল্লাহর ওলীর নেক দোয়া এবং ফয়েজ লাভ করার ব্যাপারটি-তো অবশ্যই ছিল।
হযরত দুবাগী হুজুর (রহ.) আলিম জামাতে আরবী সাহিত্যের ক্লাস নিতেন। তিনি যখন দারস দিতে শুরু করতেন তখন মনে হতো যেন একজন খাঁটি আরবী ভাষার অধ্যাপক। প্রতিটি শব্দের নাহু-ছরফের কায়দাসহ চুল-চেরা বিশ্লেষণ করে পাঠ দান করতেন। কামিল জমাতে হুজুরের কাছে আল ইতকান ফী উলুমিল কুরআন সহ অন্নান্য কিতাবাদি পড়েছি।
যখন যে বিষয়ে দারস দিতেন তখন মনে হতো সেই বিষয়েই তিনি বেশী পারদর্শী। আমার এখনো স্মরণ আছে, ক্লাসে হুজুর যখন কিছু বলে ডান হাত একটু তুলতেন তখন মধ্যমা আঙুলে থাকা রূপার আংটি চকচক করতো। পরিপাটি পোশাকপরিচ্ছদ, পরিপুষ্ট দেহসৌষ্ঠব, নূরানি চেহারা ইত্যাদিতে দুবাগী হুজুরকে একজন খান্দানী পরিবারের সন্তান বা বাদশার মতো লাগতো। তাঁর বাগ্মিতা, উচ্চারণ-ভঙ্গি, ধ্বনির মাধুর্যতা, প্রকাশের কৌশল ও তীক্ষ্ণ দূরদর্শিতা ইত্যাদি গুণাবলির বর্ণনা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। তিনি সময়কে অপচয় করতেন না। দারসের বাইরে অবসর হলেই কিতাব মুতাআলা করতেন, যেন তিনি কিতাবের এক পোকা। আল্লামা মুফতি মুজাহিদ উদ্দিন চৌধুরী দুবাগী হুজুর (রহ.) যেন ইলমের সাগর ছিলেন। যেকোনো মাসআলা-মাসায়িল এবং জটিল বিষয়ে তাঁর দারস্থ হলে সহজে সমাধান পাওয়া যেতো। তাই 'মুফতি ছাহেব' হিসেবে তাঁর সুনাম-খ্যাতি তখন সবদিকে ছড়িয়ে যায়।
হযরত আল্লামা মুজাহিদ উদ্দিন চৌধুরী দুবাগী ছাহেব (রহ.) স্থায়ী বসবাসের জন্য বৃটেন চলে গেলে তাঁর সাথে আর দেখা হয়নি। তবে অনেকের কাছে জানতে পেরেছিলাম, হুজুর সে দেশে দ্বীনি খেদমত আরও তেজস্বীভাবে চালিয়ে যাচ্ছেন। আর বাংলাদেশে হুজুরের যেসমস্ত শাগরেদ ছিলেন প্রায় সবাই বেশ দামী-গুণী আলেম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। এক্ষেত্রেও হুজুরের বিশেষ দোয়া সবার সাথে ছিল বলে আমার বিশ্বাস। কেননা, শাগরিদগণ উস্তাযের রুহানি সন্তান। রুহানি এবং জিসমানি নেক সন্তানগণ শ্রেষ্ঠ ছদগায়ে জারিয়াহ হয়ে থাকেন। আজ হুজুর আমাদের মাঝে নেই। হুজুরের ইন্তেকাল সংবাদ শুনে অসংখ্য স্মৃতি সাথে সাথে স্মরণ হয়েছে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা, হুজুরের সব ধরণের খিদমত কিয়ামত পর্যন্ত তরক্কির সাথে দায়িম ও কায়িম রাখুন এবং হুজুরকে যেন জান্নাতের আ'লা মাকাম দান করেন। আর মহান আল্লাহ তাআলা যেন আমাদেরকে তাঁর রুহানি ফয়েজ প্রদান করেন। সবার জন্য অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় আমাদের দুবাগী হুজুর (রহ.)-এর আওলাদগণকে সবার জন্য মুকতাদা মানুষ হিসেবে আল্লাহ পাক কবুল করুন, তাদের দ্বারা হুজুরের খিদমতগুলো আঞ্জাম দেয়ার তাওফিক রাব্বে কারীম দান করুন, এই কামনা করি। আ-মীন।
লেখক: মাওলানা মো. আব্দুল মজিদ
প্রাক্তন শায়খুল হাদীস- বুরাইয়া কামিল মাদরাসা এবং ইছামতি দারুল উলূম কামিল মাদরাসা।
প্রাক্তন উপাধ্যক্ষ- মাথিউরা সিনিয়র ফাযিল মাদরাসা;
প্রাক্তন আরবি প্রভাষক- সিংচাপইড় ইসলামিয়া আলিম মাদরাসা, সিলেট।
Board of Directors of ABC National News : Chief Editor and Advisor-Adv Monir Uddin, Ex.Editor and Advisor-Lion Eng.Ashraful Islam, Ex.Editor-Lion Dr.Mana and Lion Palash, Acting Editor-Tawhid Sarwar, News Editor-Aftab Parvez,News Sub Editor-Pojirul Islam and
Co-Editor Siam and Neon.
Dhaka Office : 67/4,5 Chaya Neer, Shanti Bagh Dhaka 1212.